তৃণমূল পর্যায়ে সামাজিক ব্যাধি দূরীকরণে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা
সমাজ দ্রুত বদলাচ্ছে, মানুষ সহজেই খারাপ কাজগুলোর দিকে ঝুঁকছে, এসব সামাজিক ব্যাধি দূর করতে স্থানীয় সরকার প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে
সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে কামাল হোসেন নামে এক যুবক কোনো যৌতুক ছাড়াই বিয়ে করে রাহেলা আক্তারকে (১৭)। বিয়ের কিছুদিন পর কামালের বাবা-মা রাহেলাকে বাবার বাড়ি থেকে টাকাপয়সা আনতে বলে। রাহেলা তা দিতে অপরাগ হলে কামালের মা তাকে মানসিকভাবে নির্যাতন শুরু করে। এক পর্যায়ে কামালও রাহেলাকে টাকার জন্য চাপ দেয়। এমনকি টাকা না আনলে তাকে মারধর করা এবং তালাক দেয়ার হুমকি দেয়। রাহেলা বলেন, “আমি যৌতুকের কারণে মরতে বসেছি। এটা এখন আর আমার একার বা আমার পরিবারের সমস্যা নয়। এখন এ বিষয়ে আইন রয়েছে। আমি আইনের আশ্রয় নিতে চাই। আমার সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে এর বিচার চাই।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু যৌতুক নয়, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন এবং বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রেও এ রকম নৃশংস এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটছে। তারা বলছেন, সমাজ দ্রুত বদলাচ্ছে। মানুষ সহজেই খারাপ কাজগুলোর দিকে ঝুঁকছে এবং খুবই তাৎক্ষণিকভাবে তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। তাই এসব সামাজিক ব্যাধি দূর করতে স্থানীয় সরকার প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কেননা এ ধরনের ঘটনাগুলো সাধারণত গ্রামীণ জীবনে বেশি ঘটে। তাই সহজেই তারা এ সমস্যাগুলো মোকাবেলা করে সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে।
বেসরকারি সংস্থা ‘অধিকার’এর একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, “২০০১-২০১৯ পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৪,৭১৮ জন। এর মধ্যে ৬৯০০ জন নারী এবং ৭৬৬৪ জন শিশু। এর মধ্যে দলবন্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৮২৩ জন। ধর্ষণের পর খুন ১৫০৯ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে ১৬১ জন।”
চিত্রটা ভয়ঙ্কর। একই রকম চিত্র দেখা যায় যৌতুক, নারী নির্যাতন এবং বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে- বললেন ‘জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি’র সভাপতি এবং আইনজীবী সালমা আলী। তিনি বলেন, “বাল্যবিবাহ, যৌতুক, যৌন হয়রানি কিংবা ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো সাধারণত গ্রাম পর্যায়ে বেশি ঘটে থাকে। তাই এ বিষয়ে যদি স্থানীয় সরকার প্রশাসন এগিয়ে আসে তাহলে মানুষ অনেক ভালো সেবা পাবে। বিষয়গুলো নিয়ে তারা মানুষের মাঝে নানাভাবে সচেতনতা তৈরি এবং আলোচনা করতে পারে। অনেক সময় তারা ধর্ষণ বা এ ধরনের অপরাধগুলোর বিচার শালিসের মাধ্যমে করে থাকে এবং এতে দেখা যায় ভিকটিমরা সঠিক বিচার পাননা। কেননা স্থানীয় প্রশাসন প্রভাবশালী বা শক্তিশালীদের পক্ষ নিয়ে থাকে। এটা ঠিক নয়। এতে সুষ্ঠ বিচার বা সমস্যার সমাধান হয় না।”
তিনি আরো বলেন, “সমাজে এ ধরনের অপরাধগুলো যারা ঘটিয়ে থাকে, তাদেরকে দ্রুত পুলিশের হাতে তুলে দিয়েও তারা মানুষকে সাহায্য করতে পারে। অনেক সময় ঘটনাগুলোর ভুল ব্যাখ্যা হয় এবং অপরাধ অনুযায়ী অপরাধীরা শাস্তি পায় না এবং ভিকটিমরা দুর্ভোগের শিকার হয়। এজন্য তারা একটা সুরক্ষা বলয় তৈরি করতে পারে। কোনো কোনো সমস্যা এমন হয় যা ধমক দিয়েও ঠিক করা যায়। তাদের প্রচেষ্ঠাগুলো যদি সঠিক হয় এবং এর সাথে পরিবার ও কমিউনিটি ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে তাহলে এ ধরনের সমস্যা বা অপরাধগুলো অনেক কমে যাবে।”
সরকার এ বিষয়গুলো মোকাবেলার জন্য কীভাবে কাজ করছে জানতে চাইলে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়-এর পলিসি লিডারশীপ এন্ড অ্যাডভোকেসি ইউনিট-এর সিনিয়র সহকারি প্রধান (প্লাউ) বেগম নূরুন্নাহার বেগম বলেন, “ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, যৌতুক বা বাল্যবিবাহ এ ধরণের যে কোনো ঘটনায় দেশের যে কোনো জায়গা থেকে টোল ফ্রি নম্বর ১০৯-এ ফোন করে সমস্যা বলা যায়। এরপর ভিকটিমের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন বিভাগে যেমন ডিএনএ ল্যাবরেটরি, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি), ট্রমা কাউন্সিলিং সেন্টার ইত্যাদি জায়গায় সরকারি সহায়তা পাওয়া যায় কিংবা প্রয়োজনে ভিকটিমরা আইনি সহায়তা এমনকি আশ্রয়ও নিতে পারেন। তাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহায়তা দেয়া ছাড়াও আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ বিষয়ের বিভিন্ন রিপোর্ট সংগ্রহ করি এবং তা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রিপোর্ট করে থাকি এবং নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে রিপোর্টগুলো নিয়ে নানা ধরণের কাজ হয়ে থাকে।”
‘নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী এবং সমাজকর্মী খুশী কবির বললেন. “এ বিষয়ে সরকারের আরো অনেক করণীয় রয়েছে।”
তিনি বলেন, “এসব বন্ধ করতে দলমত নির্বিশেষে আমাদের একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করা উচিত। অবশ্যই সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ করে থানা পর্যায় পর্যন্ত সরকারের যে কর্মকর্তা-কর্মচারি রয়েছেন তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন এবং তাদেরকে এ বিষয়ে অনেক দায়িত্বশীল হতে হবে। অনেক সময়ই আমরা খবর পাচ্ছি, কোনো মেয়ের বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে এগিয়ে আসছে স্থানীয় ম্যাজিজট্রেট, ইউএনও, স্কুল শিক্ষক কিংবা সাংবাদিকরা। আমার মনে হয়, উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে যারা সরকারের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করছেন তারা যদি এ বিষয়ে দায়িত্বশীল আচরণ করেন এবং এগিয়ে আসেন তাহলে আমরা খুব ভালো ফলাফল পেতে পারি। বিশেষ করে সরকারি বা বেসরকারিভাবে যদি স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের এসব বিষয়ে দায়িত্বশীল হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করা যায় কিংবা তাদেরকে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তাহলে আরো ভালো ফল পাওয়া যাবে।”
সরকার এ ধরণের সামাজিক ব্যাধি দূর করতে নানাভাবে কাজ করছে বলে জানান মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের সাবেক প্রকল্প পরিচালক ড. আবুল হোসেন। তিনিও সমাজের শৃঙ্খলা এবং শান্তি বজায় রাখতে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বকে মূল্যায়ন করেন। বাস্তবতার নিরিখে তিনি বলেন, “স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যানরা সাধারণত তাদের এলাকার মানুষদের নানাভাবে জানে এবং পরিচিত থাকে। তাই তাদের জানা থাকে কোন কোন বাড়িতে কিশোরী আছে এবং কাদের বাল্যবিবাহ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে তারা যদি ওইসব পরিবার এবং কিশোরীদের মোটিভেট করতে পারে তাহলে এভাবেও বাল্যবিবাহকে নিরুৎসাহিত করা যেতে পারে। ধর্ষণ শালিস বা আপসের বিষয় নয়। এটা অপরাধ। অনেক সময় পরিচয় বা সম্পর্কের জের ধরে নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়। আবার কখনও তারা জোরপূর্বক ধর্ষণের শিকার হন। এসব ক্ষেত্রে শালিশের মাধ্যমে বিচার না করে অপরাধীকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়াই ভালো।”
তিনি আরো বলেন, “ইউনিয়ন পরিষদে ডিজিটাল সেকশন আছে। সেটা থেকে যদি কিছু লিফটলেট ছাপানো হয় যেখানে স্থানীয় থানা, ওসির ফোন নম্বরসহ ১০৯, ৯৯৯ বা ৩৩৩ ইত্যাদি জরুরি নম্বরগুলো থাকে এবং কেউ কোনো সমস্যায় পড়লে বা নির্যাতনের শিকার হলে কীভাবে সাহায্য পেতে পারে সে সব তথ্য লেখা থাকে তাহলে এসব পরিস্থিতি মোকাবেলা করা অনেক সহজ হবে। ওই লিফটলেটে বাল্যবিবাহের তথ্যগুলো দেওয়া থাকলে এর খারাপ দিকগুলো মানুষ বুঝতে পারবে। এভাবেও স্থানীয় সরকার প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে সমাজের অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।”
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ইউনিয়ন পরিষদ অধিশাখা) মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী জানান, “সরকার এ ধরনের অনেক কাজ ইতিমধ্যে শুরু করেছে। স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদের মূল দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা। এর মধ্যে এ সমস্যাগুলো পড়ে। এগুলো মোকাবেলা করার জন্য তারা ওয়ার্ড সভা, গণশুনানী, গ্রাম আদালত, মোবাইল কোর্ট ইত্যাদি পরিচালনা করে থাকেন। এগুলোর মাধ্যমে তারা যেমন আইনগত বিষয়গুলো দেখেন, তেমনি জনসচেতনতাও তৈরি করেন। বাল্যবিবাহ, যৌতুক, ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের যে বিষয়গুলো রয়েছে সেগুলোর বিষয়ে বিশেষভাবে কাজ করার জন্য তাদেরকে প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। কাজগুলো বিভিন্নভাবে হচ্ছে এবং কিছু কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।”
এ মাসেই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। সারাদেশে এ ধরনের সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার জন্য যদি জনপ্রতিনিধিদের মানুষ অঙ্গীকারবন্ধ করতে পারেন এবং দায়িত্বশীল ও আন্তরিকভাবে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে বলেন তাইলে আশা করা যায় পরিস্থিতি অনেকটা উন্নত হবে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাহেলার কথাই ঠিক। এসব সমস্যা এখন আর কারো ব্যক্তিগত সমস্যা নয়। এখন এগুলো সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সমস্যা। এজন্য মানুষকে সরব হতে হবে। দীর্ঘশ্বাস আর চোরা কান্না মুছে ফেলে স্থানীয় প্রশাসনকে বিষয়গুলো জানাতে হবে। তাহলে স্থানীয় প্রশাসন ও সমাজ এগিয়ে আসবে। এজন্য স্থানীয় সরকারকে আরও স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন- বলে বলছেন সুশীল সমাজ এবং সংশ্লিষ্টরা।