সরকারি চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি ও করোনাকাল

 সরকারি চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি ও করোনাকাল




আমাদের এ মাতৃভূমি বাংলাদেশ অঞ্চলে ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলে সরকারি অর্থাৎ Indian Civil Service (ICS) এবং Civil Service of Pakistan (CSP) ছিল ক্যারিয়ার গড়ার সবচেয়ে লোভনীয় চাকরি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রায় শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক সংস্থার চাকরি চলে আসে প্রথম অগ্রাধিকারে; এরপরই স্থান পায় বেসরকারি কর্পোরেট বডির চাকরি, সরকারি


চাকরির স্থান হয় তিন নম্বরে। কিন্তু ইদানীং সরকারি চাকরি আবার ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলের মতো প্রথম স্থান দখল করে নিয়েছে। অথচ এ সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের ব্যাপারে শুধু বয়সের মারপ্যাঁচ কিছু অন্যায়-অবিচার ও শ্রীহীন-অসুন্দর হিসেবে শেকড় গেড়ে বসেছে। প্রথমে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বিষয়টি লক্ষ করা যাক। বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে

একসময় সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ছিল ২৫ বছর; স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দিক থেকেই চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ২৭ বছরে উন্নীত করা হয়। আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেশনজটের ফলে শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ স্নাতক, বিশেষত স্নাতকোত্তর শিক্ষা ২৭ বছর বয়সের মধ্যে শেষ করতে পারছিল না। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরাধিক

সামরিক-আধাসামরিক শাসনের পর দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনে নতুন গণতান্ত্রিক সরকার বিষয়টি অনুধাবন করে ১৯৯১ সালে ১৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে চাকরিতে প্রবেশের বয়স তিন বছর বাড়িয়ে ৩০ বছরে উন্নীত করে। কিন্তু বিশ্বায়নের এ যুগে দেশের অবস্থাও দ্রুত বদলাতে থাকে। দিনবদলের এ ধারায় চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো জরুরি

হয়ে পড়েছে। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান রাফি ৩০ জুলাই দৈনিক শিক্ষায় প্রকাশিত ‘সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা’ শীর্ষক লেখায় চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর পক্ষে কিছু যুক্তি তুলে ধরেছেন : ১. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেই লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে; কিন্তু কর্মসংস্থানের অভাবে প্রতিবছর

বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা; ২. উচ্চশিক্ষার পাঠ্যসূচির সঙ্গে বিসিএসসহ চাকরির পরীক্ষা-কোর্সের বিস্তর পার্থক্য থাকায় তাদের আবার নতুন করে চাকরির পড়াশোনা করতে হয়; ৩. বৈশ্বি^ক মহামারী করোনার কারণে শিক্ষার্থীরা এখন ঘরবন্দি, সাত-আট মাস ধরে কোনো চাকরির আবেদনও করতে পারছে না; ৪. পরিণামে বেকারদের অনেকের মনোবল ভেঙে গেছে,

অন্যদেরও যাচ্ছে। এসব বিবেচনায় তরুণ শিক্ষার্থী রাফির যৌক্তিক জোর দাবি : তাদের ওপর বয়সের বাধার মতো উটকো ঝামেলা এড়িয়ে, তাদের ভাঙা মনোবল চাঙা করতে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা একটু বাড়িয়ে দেয়া হোক। একই বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক একেএম শাহনাওয়াজ ২ সেপ্টেম্বর যুগান্তরে প্রকাশিত ‘দক্ষতা ও যোগ্যতার অপচয়

কাম্য নয়’ শীর্ষক নিবন্ধে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর পক্ষে নতুন কিছু যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন : ১. চাকরিপ্রার্থীর তুলনায় পদ অনেক কম থাকায় চাকরিযুদ্ধে অংশ নিয়ে জয়ী হওয়ার জন্য গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পরও চার-পাঁচ বছর সময় দরকার হয়; ২. চাকরিতে প্রবেশের সরকারি বয়সসীমা অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও অনুসরণ করে বলে প্রার্থীরা সেসব চাকরির

সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হয়। চাকরির সীমিত সুযোগ এবং করোনার কারণে এবার বিসিএস পরীক্ষা স্থগিত থাকায় প্রার্থীরা ৫-৬ মাস নয়, পুরো একটি বছর পিছিয়ে পড়েছে। আসন্ন শীতে করোনার নতুন ঢেউ এলে সেটি দু’বছরে পৌঁছার সমূহ আশঙ্কা তৈরি করবে। আর বিপুল আয়োজনে দেশমাতৃকার তরুণদের লেখাপড়া শিখিয়ে বয়সের মারপ্যাঁচে ফেলে বেকারত্বের গ্লানি উপহার

দেয়া তো কোনো কল্যাণকামী রাষ্ট্রের নীতি হতে পারে না। এবার আসা যাক সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়স সম্পর্কিত আলোচনায়। বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে একসময় সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়স ছিল ৫৫ বছর। দেশের স্বাধীন অস্তিত্বের প্রায় শুরু থেকেই অবসরের বয়স ৫৭ বছর করা হয়। এ অবস্থা প্রায় ৩৬ বছর চলে। ১৩তম বিসিএস থেকে শুরু করে

চাকরিতে প্রবেশের বয়স একবারে তিন বছর বৃদ্ধির সাপেক্ষে অবসরের বয়সও তিন বছর বাড়ানোর মজবুত যুক্তি থাকলেও সরকার ২০০৯ সালে তা মাত্র দু’বছর বাড়িয়ে ৫৯ বছর করে। বয়সের এ সংখ্যাটি আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়নি। অবসরের বয়স বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে অধ্যাপক শাহনাওয়াজ তার নিবন্ধে যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ১.

স্বাধীন হওয়ার পরও বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৫২ বছর; যা বিগত ৪০-৪৫ বছরে বেড়ে হয়েছে প্রায় ৭৩ বছর; ২. অকালে অবসরে যাওয়া এ মানুষ সুস্থতার বিচারে আরও দীর্ঘদিন কর্মক্ষম থাকছেন; কিন্তু কর্ম পাচ্ছেন না (ফলে হতাশায় নিমজ্জিত হওয়ার প্রচুর আশঙ্কা রয়েছে); ৩. সুস্থসবল দক্ষ ও অভিজ্ঞ এ মানুষের সেবা না নেয়া জাতীয় অপচয়; ৪. কয়েকটি

দেশে অবসরের বয়স (যেমন- ভারতে ৬০ বছর, সুইজারল্যান্ড ও সুইডেনে ৬৫ বছর এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ানে ৬৬ বছর) বাংলাদেশের এ বয়স থেকে ঢের বেশি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কল্যাণকামী হওয়ার কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। জাতিসংঘ ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ অর্জনের প্রধান উপায় আমজনতার চিন্তাভাবনার প্রতি সংবেদনশীল হওয়া এবং

তা সাদরে গ্রহণ করে অন্তর্ভুক্তিমূলক (Inclusive) সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রপরিচালনা করা। তরুণদের দাবি ও আন্দোলনকে গুরুত্ব দেয়া এবং বয়স্কদের অভিজ্ঞতা আরও কিছুদিন কাজে লাগানোর চিন্তা বছর দুই আগে সরকারের মধ্যেও দেখা গিয়েছিল। তার নির্যাস বয়োজ্যেষ্ঠ মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৮ সালের প্রথমার্ধে গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, অচিরেই

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বেড়ে ৩২-৩৫ এবং অবসরের বয়স বেড়ে ৬০-৬২ বছর হচ্ছে। স্কুলজীবনে দু’লাইন কবিতা পড়েছিলাম : অসুন্দরে নাশবি যদি, গড়বি নব নন্দনে রে। এটি কার কবিতা, শিরোনামই বা কী, তা এখন আর মনে পড়ছে না। কিন্তু সবাই বোঝেন- নতুন নন্দন (বাগান) সৃষ্টি করতে হলে বর্তমানে যা কিছু অসুন্দর, জঞ্জাল রয়েছে, তা নাশ (হত্যা) বা দূর

করেই এগোতে হয়। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বর্তমান বয়সটি (্৫৯ বছর) অসুন্দর ঠেকে। তাছাড়া করোনার কারণে এবার অধিকাংশ নিয়োগ বন্ধ বা স্থগিত থাকায় অনেক পদ খালি পড়ে থাকছে। শুধু ৪১টি সরকারি কলেজে নাকি অধ্যক্ষের পদ ফাঁকা! তাই তাড়াহুড়ো করে ৫৯ বছরে অবসরে পাঠানোর বিষয়টি অচিরেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক, ব্যবস্থাপনাসহ সব

কর্মে স্থবিরতা তৈরি করতে পারে। চাকরিজীবী মহলে একটি কথা ভেসে বেড়াচ্ছে : স্বাধীন বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে (অর্থাৎ ২০২১ সালে) প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির বয়সের উল্লিখিত সমস্যার সমাধানকে সরকার উপহার হিসেবে দিতে পারে। যদিও এটি কোনো খবর নয়, বরং বাতাসে ভেসে বেড়ানো ধোঁয়ার মতো, তবে এর কোনো সত্যতা থাকলে খুব বলতে

ইচ্ছে করে- যে বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার জনগণকে পশ্চিম পাকিস্তানি দুঃশাসন থেকে মুক্তির পথে উদ্বুদ্ধ করেছেন, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের জন্য তাদের সংগঠিত করেছেন, সেই জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে এবারই কেন সে-ই উপহারটি দেয়া হচ্ছে না? আশা করি, সদাশয় সরকার সব দিক বিবেচনায় নিয়ে অতিসত্বর সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স অন্তত ৩২ বছরে উন্নীত

করে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে সৃষ্ট হতাশা ও অবিচারের ধারণা দূর করবে। একই সঙ্গে নিয়োগ পরীক্ষার জন্য তিন বছর বরাদ্দ ধরে ২৫ বছর কর্মকাল রাখার প্রয়োজনে অসুন্দর সংখ্যা ঊনষাটের পরিবর্তে অবসরের বয়স অতিসত্বর অন্তত পূর্ণ সংখ্যা ৬০ বছরে উন্নীত করাও খুবই দরকার।

করোনাকালে নিয়োগ প্রায় বন্ধ থাকার ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনা ও বজায় রাখার স্বার্থেও এ মুহূর্তে অবসরের বয়স ৬০ বছরে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়ে, সম্ভব হলে গত জুলাই থেকে তা ভূতাপেক্ষভাবে কার্যকর করা জরুরি কর্তব্য বলে মনে করি। ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা : শিক্ষা গবেষক এবং বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার সদস্য asmolla@ymail.com

Post a Comment

Previous Post Next Post