ওয়ানডেতে কি তাহলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য অজেয় এক দলই হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ? দেশে–বিদেশে মিলিয়ে এ নিয়ে ক্যারিবীয়দের টানা ৯ ম্যাচে হারানোর পর কথাটা বলতে বাধা কোথায়!
এবারের সফরের আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সর্বশেষ আট ওয়ানডের সবগুলোতেই জয় বাংলাদেশের। আরেকটু পিছিয়ে যদি ২০১৮ সালের সর্বশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকে হিসাবটা ধরেন, তাহলে ম্যাচ পাবেন ১৩টি। এই ১৩ ম্যাচে বাংলাদেশের জয়ের সংখ্যা ১১, হার মাত্র দুই ম্যাচে।২০১৮ সালে যেহেতু ফিরে গেলেনই, একটু গায়ানার প্রভিডেন্স স্টেডিয়াম হয়েই যান। ২০১৮ সাল থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডেতে যে জয়রথ ছুটছে বাংলাদেশের, সেটার শুরু এখান থেকেই। সেবার ২–১-এ জেতা সিরিজের প্রথম দুটি ম্যাচ বাংলাদেশে খেলেছিল এ মাঠে, যার প্রথমটিতে জয় ৪৮ রানের। গতকাল রোববারের জয়টিসহ ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে বাংলাদেশ জিতল টানা ৯টি ওয়ানডে।
এবার ওয়ানডে সিরিজের তিনটি ম্যাচই গায়ানাতে, যার প্রথমটি ৬ উইকেটে জিতে বাংলাদেশ দল শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জয়ের ধারাবাহিকতাই ধরে রাখেনি, টেস্ট এবং টি–টোয়েন্টির ব্যর্থতার পর কিছুট স্বস্তিও দিচ্ছে এই জয়।
সকালের বৃষ্টিতে মাঠ ভেজা থাকায় খেলা শুরু হয়েছে বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে, ম্যাচের দৈর্ঘ্য কমিয়ে আনা হয় ৪১ ওভার। তাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের করা ১৪৯ রান ৪ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ টপকে যায় ৩১.৫ ওভারেই।
অতীত অভিজ্ঞতা বলে এরকম অল্প রানের ম্যাচে অনেক সময় ব্যাটিংয়ে গুবলেট করে বসে বাংলাদেশ। শুরুতে কয়েক উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে গেলে মিডল অর্ডারে ভর করে অজানা আতঙ্ক। অল্প রানই তখন হয়ে যায় পর্বতসম। তবে গত মার্চে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে এরকম ম্যাচ জেতার একটা পথ আবিষ্কার করে ফেলেছে বাংলাদেশ। লক্ষ্য ছোট বলে হেলুদুলে নয়, জয় তুলে নিতে হবে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করে। এই নীতি মেনেই সেঞ্চুরিয়নে এসেছিল সিরিজ জয়। শেষ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার ১৫৪ রান তামিম ইকবাল–লিটন দাসের ১২৭ রানের ওপেনিং জুটিতে মাত্র ২৬.৩ ওভারেই টপকে গিয়েছিল বাংলাদেশ। জয় এসেছিল ৯ উইকেটে।
কাল ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই লিটন এলবিডব্লু হয়ে যাওয়ায় প্রভিডেন্স স্টেডিয়ামে সে পথে এগুনো যায়নি। ব্যক্তিগত ৩৩ রানে রানআউট হয়ে যান অধিনায়ক তামিম ইকবালও। ৪৯ রানে দুই ওপেনারকে হারানোর পর বাকি দূরত্ব নাজমুল হোসেন আর মাহমুদউল্লাহর জুটিতে পার করে আসাটাই হতো আদর্শ।
কিন্তু জুটিতে ৪৯ রান হতেই শর্ট মিড উইকেটে সহজ ক্যাচ দিয়ে ফেরেন নাজমুল। মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে জুটি বেঁধে আফিফ হোসেনও পারেননি জয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরে আসতে, যেটা পেরেছেন নুরুল হাসান। ২৭ বলে ২০ রানে অপরাজিত নুরুলকে সঙ্গে নিয়ে মাহমুদউল্লাহ মাঠ ছেড়েছেন ম্যাচ জিতিয়েই। জেইডেন সিলসের বলে চার মেরে সেরেছেন জয়ের আনুষ্ঠানিকতা। ফর্মের অভাবে ধুঁকতে থাকা সময়ে এই ইনিংস কিছুটা হলেও আত্মবিশ্বাসের অক্সিজেন দেবে মাহমুদউল্লাহকেএর আগে বল হাতে ক্যারিয়ারের সেরা পারফরম্যান্স করেছেন শরীফুল ইসলাম। নামের পাশে ৩৪ রানে ৪ উইকেট। তবে ম্যান অব দ্যা ম্যাচ হয়েছেন ৩ উইকেট পাওয়া মেহেদী হাসান মিরাজ। কেন, সেটা মিরাজের উইকেটগুলো দেখলেই বুঝবেন। কাইল মায়ার্স, নিকোলাস পুরান ও রোভম্যান পাওয়েল—ওয়েস্ট ইন্ডিজকে যারা নির্ভরতা দিতে পারতেন তাঁদের কাউকেই উইকেটে দাঁড়াতে দেননি এই অফ স্পিনার। ওদিকে নাসুম আহমেদ ও তাসকিন আহমেদের উইকেটের ঘর একেবারেই ফাঁকা। উইকেট নিতে পারার বাড়তি কৃতিত্ব অবশ্যই দিতে হবে শরীফুল আর মিরাজকে। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসটা ১৪৯ রানে আটকে রাখতে ভূমিকা আছে সব বোলারেরই। অবশ্য সহজ সহজ সব ক্যাচ হাতছাড়া না করলে স্বাগতিকদের সংগ্রহটা হতে পারত আরো কম। ১১০ রানে ৯ উইকেট হারানোর পর তাদের ইনিংসে সর্বোচ্চ ৩৯ রানের জুটিটা হয়েছে কিনা শেষ উইকেটে!
অ্যান্ডারসন ফিলিপ আর সিলসের শেষ উইকেট জুটিতেই ক্যাচ পড়েছ তিনবার, এসেছিল রানআউটের সুযোগও। ৩৫তম ওভারে ১১২ রানে অলআউট করে দেওয়ার সুযোগ এসেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। কিন্তু ফিলিপের আকাশে তুলে দেওয়া বলটি দৌড়ে গিয়ে হাতে লাগিয়েও ধরতে পারেননি বোলার মোস্তাফিজুর রহমান।এরপর ৩৮ ও ৩৯, পরপর দুই ওভারে ক্যাচ দিয়েও বেঁচে যান সিলস। প্রথমবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান ছিল ১২১। শরীফুলকে প্রথম পঞ্চম উইকেট পাওয়া থেকে বঞ্চিত করে লং অফে এবার ক্যাচ ফেলেন মাহমুদউল্লাহ। ৩৯তম ওভারে দুর্ভাগা বোলার আবারো মোস্তাফিজ, মিডউইকেটে মোটামুটি সহজ ক্যাচটি ছাড়েন আফিফ।
ক্যাচ ছাড়ার শুরুটাই অবশ্য হয়েছে মোস্তাফিজের বলে। মন্থর উইকেটে ভালোই সুবিধা পাচ্ছিলেন এই বাঁহাতি পেসার। কাটার করছিলেন, নিজেও মাঝে মাঝে দিচ্ছিলেন স্লোয়ার। ৩৩তম ওভারে সেরকমই এক স্লোয়ার বুঝতে না পেরে লং অনে উঁচু ক্যাচ দিলেন গুড়াকেশ মোতি। সহজ সেই ক্যাচটাও নিতে পারেননি শরীফুল, হাত থেকে বেরিয়ে যায় বল।ফিল্ডিংয়ে সবার হাত এমন পিচ্ছিল না হয়ে উঠলে বাংলাদেশ ব্যাটিংটা করতে পারতো আরো নির্ভারভাবে। বোলাররা সবাই মিলে সেই পথটাই তৈরি করে দিয়েছিলেন। সকালের বৃষ্টির পর তিন বার মাঠ পর্যবেক্ষণ শেষে শুরু হয় ম্যাচ। বৃষ্টি পরবর্তী কন্ডিশনের কথা মাথায় রেখেই হয়তো অধিনায়ক তামিম টসে জিতেও ব্যাটিং নিলেন না। উল্টো ইনিংসের প্রথম ওভারটাই করতে দিলেন অভিষেক ওয়ানডে খেলতে নামা বাঁহাতি স্পিনার নাসুমকে।প্রথম ওভারে মাত্র ১ রান দেওয়া নাসুম উইকেট না পেলেও ৪৮ বলের মধ্যে ৪০টিতেই কোনো রান দেননি। এর মধ্যে ইনিংসের তৃতীয় ও নিজের দ্বিতীয় ওভারে শামার ব্রুকসের বিপক্ষে এলবিডব্লুর আবেদন করে আউটও আদায় করে নিয়েছিলেন। কিন্তু রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান ব্রুকস।
৮ ওভারে ২৫ রান দিয়ে উইকেটশুন্য থাকা তাসকিনের বলেও ছিল চেনা আগ্রাসন। অপরপ্রান্ত থেকে নাসুম–তাসকিনরা ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানদের কিছুটা চেপে ধরাতেই সুযোগটা নিয়েছেন আরেক প্রান্তের বোলাররা। শরীফুল তো ৪ উইকেট পেলেন দুই বার জোড়া আঘাত করে, একবার সৃষ্টি করেছিলেন হ্যাটট্রিকের সুযোগও।